আচার্য হরিনাথ দে’র মতো বহুভাষাবিদ পন্ডিত, শুধু ভারতবর্ষে নয় ,সারা বিশ্বেই এমন অসাধারণ প্রতিভা বিরল।
সূচনা
ভারতবর্ষ রত্নগর্ভা দেশ। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে এমন সন্তান জন্ম দিতে এই দেশ কখনো বিরত হয় নি । যুগে যুগে এমন উদাহরন প্রচুর। এমনই একজন মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি হলেন আচার্য হরিনাথ দে। তাঁর মত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষ ভারতবর্ষে খুব কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। যদিও এই প্রতিভাশালী মনীষী 1911 সালের 30 শে আগস্ট মাত্র 34 বছর বয়সেই ইহলোক ত্যাগ করেন । যখন তাঁর যৌবন- সূর্য মধ্যগগনে দীপ্যমান ।
আগমন
হরিনাথ দে 1877 সালের 12 ই আগস্ট (মতান্তরে 187 / বাংলা 1284 সন 29 শ্রাবণ) রবিবার, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তর 24 পরগনা জেলার আড়িয়াদহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রায় ভূতনাথ দে বাহাদুর ছিলেন মধ্যপ্রদেশের রায়পুরের প্রসিদ্ধ আইনজীবী ।তবে হরিনাথের জীবনে তার মায়ের ভূমিকা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ ।এই প্রসঙ্গে একটি কথা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য ।
নেপোলিয়নবোনাপার্ট বলতেন, “মায়েরাই প্রকৃতরূপে সন্তান ও জাতিকে গড়ে তোলেন। যে মা মহীয়সী তার সন্তান হয় মহান”। হরিনাথের মা ছিলেন ইংরেজি, বাংলা ,মারাঠি ও হিন্দি ভাষাতে বিশেষ পারদর্শী ।অসামান্য জ্ঞানস্পৃহা ধীরে ধীরে জারিত হয় বালক হরিনাথের মধ্যে। মাত্র 4 বছর বয়সে তিনি বাবার কাছ থেকে পুরো বাইবেল আত্মস্থ করেছিলেন। এইরকম মহান মনীষীদের জীবন কথা জানার জন্য এখনই ক্লিক করুন এখানে।
ছাত্র জীবন / স্বদেশ-বিদেশ
একেবারে শিশুকাল থেকেই হরিনাথের পড়াশোনার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি প্রথমে মধ্যে ইংরেজি পরীক্ষায় মাসিক 5 টাকার বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হন ।এরপর শুধু উত্তরণের ইতিহাস। 1893 সাল, তিনি প্রেসিডেন্সির ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাতিন ও ইংরেজি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে সরকারি বৃত্তি লাভ করেন।
1897 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন এবং গ্রীক ভাষায় প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এম.এ তে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এছাড়াও এখানেই তিনি লাতিন ও হিব্রু ভাষাতেও শিক্ষা লাভ করেন।ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই 1900 সাল নাগাদ ‘ক্লাসিক্যাল ট্রাইপস্’ পরীক্ষায় প্রথম ভাগ ও মধ্যযুগীয় আধুনিক ভাষাতে ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময় তিনি লাতিন ও গ্রিক কবিতা অনুবাদের জন্য ‘কিটস্ পুরস্কার’ ও ‘চ্যান্সেলর পদক’ প্রাপ্ত হন।
ইংল্যান্ডের রাজকবি টেনিসন ও মিল্টন এককালে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই জন্য এই পুরষ্কার হরিনাথ সহ সমস্ত ভারতীয় কে গর্বিত করেছিল। তিনি এশিয়া ও ইউরোপের 34 টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, ত্রিশ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ।
ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক ভাষায় এম.এ পরীক্ষা দেন ইংল্যান্ডে বসেই। শুধুমাত্র হরিনাথের মেধার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সাধারণ নিয়মের বাইরে বেরিয়ে এই পরীক্ষা গ্রহণ করে। হরিনাথ সসম্মানে সেই পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় ও মিশর থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা করেন।
তারপর জার্মানির মারমুগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত, তুলনামূলক ব্যাকরণ ও আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি France, Germany, Switzerland, Spain, Portugal ,Italy প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে সেখানকার ভাষার সর্বোচ্চ পরীক্ষাগুলো পাস করেন। হরিনাথ মাত্র 22 বছর বয়সে I.E.S পদ লাভ করেন। তখনকার দিনে I.E.S পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল সকলের পক্ষে
অধ্যাপনা জীবন
প্রথাগত শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে হরিনাথ দে ভারতবর্ষে প্রত্যাগমন করে ভারতীয় শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন। কিছুদিন ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করার পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বদলী হন। এই প্রসঙ্গে আচার্য হরিনাথের একজন প্রাক্তন ছাত্র তার সম্বন্ধে লিখেছিলেন,
“একদিন শুনলাম ঢাকা কলেজ থেকে প্রফেসর হরিনাথ দে আমাদের পড়াতে আসছেন। আমরা ইতিপূর্বে তার বিশ্ববিখ্যাত নাম শুনেছিলাম। আমরা সকলে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তার আগমনের প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। সাধারণতঃ কোন নতুন শিক্ষক যোগদান করলে ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে একটু জ্বালাতন করে। কিন্তু তিনি যখন পড়াতে এলেন সেরকম কোনো ঘটনাই সেদিন ঘটেনি। তাঁর বড় বড় দুটি চোখের ভেতর ছিল অদ্ভুত সম্মোহনী জ্যোতি ।কন্ঠের স্বরে ছিল গাম্ভীর্য –ছাত্র- ছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নীরবে সেদিন পাঠ গ্রহণ করেছিল। সে সময় মিল্টনের “কোমাস” ও হেল্পসের “এসেস” আমাদের পাঠ্য ছিল। তিনি গ্রীকও লাতিন ভাষায় সুপন্ডিত হবার সুবাদে কোমাসের allusion গুলি এত ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, পরবর্তীকালে আমাদের আর দ্বিতীয়বার বই পড়ার প্রয়োজন হয়নি।“
অসাধারণ পান্ডিত্য
আধুনিক ও প্রাচীন ইউরোপীয় সাহিত্য এবং ভাষাতেও হরিনাথের ছিল অসাধারণ পারদর্শিতা। এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সুপন্ডিত পারসিভাল সাহেব ছাত্রদের নিকট বলেছিলেন,Yes,he (Harinath) can teach me Latin and Greek for several years.
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার পর হরিনাথ দে হুগলি কলেজের অধ্যক্ষ পদ প্রাপ্ত হন। কিন্তু অধ্যাপনা তাঁকে যেন কাঙ্ক্ষিত শান্তি দিতে পারছিল না। তাঁর আনন্দ ছিল অধ্যায়নে। তিনি অনেক সময় বলতেন “,একাজ (অধ্যাপনা)আমার ভালো লাগেনা। ইহাতে আমার ছেলেদের বিশেষ উপকার করিতে পারি না ।নিজেরও কোনো উপকার হয় না। বরং পড়াশোনার বড়ো ক্ষতি হয় ।“
1960 সালে চীনের প্রধানমন্ত্রী হরিনাথের গৃহে পদার্পণ করেন। এর পুর্বে আর কোন ভারতবাসী এই উচ্চতম সম্মানের অধিকারী হননি।
লাইব্রেরিয়ান
অবশেষে হরিনাথের মনোবাসনা পূর্ণ হলো । তিনি কলকাতা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর (বর্তমানে ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার / National library) লাইব্রেরীয়ান পদে যোগ দিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ।এই পদে যোগ দিয়ে পড়ার সাধ মেটাবার পূর্ণ সুযোগ তিনি পেয়ে যান । এরপরে বাকি জীবন তিনি নিজেকে নিমজ্জিত রেখেছিলেন অধ্যায়নে । শুধু পড়া আর পড়া। সারাটা জীবন কি পড়া-ই না পড়েছেন। অমন আত্মভোলা ,অধ্যায়নশীল মানুষ বড় একটা দেখা যায় না।
হরিনাথ দের ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ।সেই কারণে মাত্র 34 বছরের জীবনে তিনি এত বিষয় অনায়াসে আয়ত্ত করেছিলেন । ছাত্রাবস্থায় তিনি একবারে বেশিক্ষণ পড়তেন না ।কখনো বেশি রাত জেগে পড়াশোনা করতেন না। অথচ যা একবার পড়তেন তা কোনদিন ভুলতেন না। মেধার পাশাপাশি তাঁর ছিল একনিষ্ঠ অধ্যবসায় যা তিনি তাঁর মায়ের থেকে পেয়েছিলেন।
যখন তিনি নিবিষ্টচিত্তে পড়াশোনা করতেন, তখন ,বাইরে কোলাহল, সংসারের নানা ঝঞ্ঝাট ,তাঁর ধ্যান-তপস্যায় বিঘ্নঘটাতে পারতো না। পুঁথির মধ্যে তিনি অতন্দ্রিতভাবে তন্ময় হয়ে থাকতেন। অনেক সময় তাঁর চারপাশে কত লোক আড্ডা মেরেছে, সেদিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপও ছিল না। ।সমগ্র মন পুঁথিতেই নিমগ্ন। কোনদিনও পরীক্ষার সময় তাঁকে বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। দুদিন পরে পরীক্ষা, হরিনাথ মহানন্দে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে, গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছেন। অথচ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে ,সকলে সবিস্ময়ে দেখলো হরিনাথের নাম সকলের আগে ।
বহুভাষাবিদ
আচার্য হরিনাথ দে র মতো বহুভাষাবিদ পন্ডিত এশিয়াতেও আর কেউ ছিল না। তিনি সর্বমোট 34 টি ভাষা জানতেন। তিনি দ্বিতীয়বার বর্ধমানের রাজার ভ্রমণ সহায়ক (Guide) হয়ে ইউরোপে গিয়েছিলেন। বর্ধমান রাজ ইতালিতে গিয়ে রোমনগরে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।পোপ বিদেশিদের সাথে সাক্ষাতের সময় ল্যাটিন ভাষা ব্যবহার করতেন। যদিও ইতালির প্রচলিত ভাষা ছিল ইটালিয়ান। ল্যাটিন ছিল ভারতের সংস্কৃতের ন্যায় ইতালীয়দের প্রাচীন ভাষা ।পোপের সঙ্গে আলাপের সময় হরিনাথ দোভাষীর কাজ করেন। তিনি এমন চমৎকার ল্যাটিন বলেছিলেন যে, একজন বিদেশী বিশেষতঃ ভারতবাসীর দক্ষতা দেখে পোপ অবাক হয়ে গেছিলেন।
আরেকবার বিখ্যাত রুশ পন্ডিত বারবাটস্কি হরিনাথের পান্ডিত্যে এমন মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তাকে সেন্ট পিটার্সবার্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে কার্যভার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। হরিনাথ সেই প্রস্তাব সবিনয়ে নাকচ করে দেন। কারণ স্বদেশ ছেড়ে রুশ দেশে যেতে তার মন সায় দেয়নি।
এই বিশ্ববরেণ্য মানুষটি একসময় অনেক লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন ।একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত পরীক্ষার প্রশ্ন প্রত্যন্ত কঠিন হয়েছিল। হরিনাথ এর তীব্র প্রতিবাদ করলে ,তৎকালীন পন্ডিত মহল ব্যঙ্গ করে বলেছিল ,”হরিনাথ সংস্কৃতের কি বুঝবে !” এর কিছুদিন পরে ,সেই প্রাপ্ত,বয়সে সংস্কৃতে এম.এ পরীক্ষা দিয়ে সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রমাণ করে দেন সংস্কৃত ভাষাতে তিনি কোনো অংশে কম নয় ।
ব্যক্তিগত জীবন ও রচনা
অসাধারণ পন্ডিত ছিলেন হরিনাথ। কিন্তু পাণ্ডিত্যের অভিমান তাকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি। প্রাণখোলা ওই মানুষটিকে দেখে, কখনোই মনে হতো না তিনি একজন বহুভাষাবিদ বিশ্ববরেণ্য পন্ডিত ।তিনি সাধারণ পোশাকে সরল জীবনযাপন করা একজন সদাহাস্যময় মানুষ ছিলেন। তাঁর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তিনি সবসময় গল্পগুজব আড্ডা কলহাস্যে সময় কাটাতেন।তাঁর জীবনে বিদ্যা ও বিনয়ের যুগল সম্মিলন ঘটেছিল।
এই মহামনীষীকে কিছু লিখবার কথা বললে স্বভাবসুলভ বিনয়ে নম্রভাবে উত্তর দিতেন—“শিখলাম কি যে লিখবো ? এখনো শিখবার যথেষ্ট বাকি।“ তবু তিনি যেসব বিষয়ে স্পর্শ করেছিলেন সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ।তাঁর সম্পাদনায় 1902 সালে “Macaulay’s Essay on Milton” প্রকাশিত হয়েছিল। 1903 সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় “Palgrave’s Golden Treasury”. এছাড়া তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদনা, অনুবাদ ও গবেষণা কর্মের মধ্যে রয়েছে ইংলিশ- পার্শিয়ান লেক্সিকন সংকলন, মূলসহ ঋক্বেদের অনেক শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত-এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। তিনি গ্রীক,আরবি,ফারসি, পালি ,বাংলা , ইতালীয়,রুশ ভাষার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন ।
উপার্জন
আচার্য হরিনাথ অর্থের ভিখারী ছিলেন না। তিনি শৈশব থেকে অবস্থাপন্ন শিক্ষিত পরিবারে লালিত হয়েছিলেন। তাছাড়া সেই সময়ে বিভিন্ন বৃত্তি ও পারিতোষিক হিসাবে তাঁর উপার্জন ছিল এক লক্ষ টাকা। দানের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন উদার। কেউ কখনো প্রার্থী হিসেবে বিফল মনোরথে ফেরেনি তাঁর কাছ থেকে।
এমন হয়েছে পাওনাদার নির্দিষ্ট দিনে টাকা নিতে এসেছে, হরিনাথও দেবার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু সেই সময় কোন একজন বিপন্ন আগন্তুকের কাতর প্রার্থনা তাঁকে বিচলিত করলো। একান্ত নিরুদ্বেগে হাতের টাকা দান করলেন সেই বিপন্ন মানুষটিকে ।এরজন্য মাঝেমধ্যে তিনি বড় সমস্যার সম্মুখীনও হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে মৃত্যুকালে বৃদ্ধা মা ,স্ত্রী ও পুত্রাদির জন্য সেরকম কোন সংস্থান রেখে যেতে পারেনি। অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয় এর ব্যাপারে তিনি ছিলেন চরম অপরিণামদর্শী ।
বই ও ছাত্র প্রীতি
বই কেনা ছিল তার জীবনের প্রধান সখ। ভালো বইয়ের সন্ধান পেলে তৎক্ষনাৎ সেটা কিনতে ছুটতেন তিনি ।এমনকি বেশি দাম দিয়েও তিনি সেই বই সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন বিষয়ের অসংখ্য বই তাঁর লাইব্রেরীতে (National Library) স্থানপেয়েছিলো। নানা দেশের, নানা ভাষার, এরকম বিচিত্র সংগ্রহ বোধহয় আমাদের দেশে খুব কম লাইব্রেরীতেই আছে। হরিনাথের নিজস্ব সংগ্রহ ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরীতে ছিল নানা ভাষার মূল্যবান প্রায় 60 হাজার টাকার গ্রন্থ। তিনি প্রাপ্ত বয়সে দৈনিক প্রায় 17 /18 ঘন্টা পড়াশোনা করতেন।নিজের লাইব্রেরীর প্রত্যেকটি বই ছিল হরিনাথের পড়া।
ছাত্রদের জন্য দরদী হরিনাথের স্নেহের অন্ত ছিল না। কত দরিদ্র ছাত্র যে তাঁর সাহায্য পেয়েছে, তাঁর হিসেব নেই। কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের যে স্টুডেন্ট ফান্ড আছে তা মূলত হরিনাথের সাহায্য ও সহানুভূতির প্রতিশ্রুতিতেই প্রতিষ্ঠিত । এমনকি ছাত্রদের নানান অভাব-অভিযোগের প্রতিকারের জন্য ছাত্রদের মুখপাত্র হয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতেন ।এজন্য ছাত্র- ছাত্রীরা তাকে ভালোবাসতো এবং পরম শ্রদ্ধা করত ।
জীবন দীপ
মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন হরিনাথ। টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত ।স্নেহময়ী মা সন্তানের হাতে রক্ষাবন্ধনী ও চোখে হোমধূমের কাজল পরিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হল না। ব্যর্থ হলো মায়ের কাতর প্রার্থনা। বৃথা গেল দেবতার অর্চনা । মাত্র 34 বছর বয়সে, সংসারের সকল বাঁধন ছিন্ন করে জীবনের পরপারে যাত্রা করেন। 1911 সালের 30 শে আগস্ট বুধবার, (বাংলা 1318 বঙ্গাব্দের 13ই ভাদ্র,) এই মহামনিষী বঙ্গ ভূবন অন্ধকার করে মহাপ্রয়াণ করলেন। গমন করলেন দিব্যধামে।
এই মহামানব, বিশ্বভারতীর বরপুত্র, বাংলার মহামনীষী আচার্য হরিনাথকে আজও বিশ্ববাসী শ্রদ্ধা জানাই তাঁর সৃষ্টি ও কর্মের জন্য। দেশ বা জাতির যে কোনো সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানে দেশবাসী অনুভব করবে আচার্য হরিনাথের প্রকৃত উপস্থিতি ।